হরপ্পা/সিন্ধু সভ্যতা - Harappan/Indus Valley Civilization

নামকরনঃ
  1. হরপ্পা সভ্যতাঃ- প্রথম আবিষ্কৃত কেন্দ্র হরপ্পা তাই এই নামকরণ।
  2. সিন্ধু সভ্যতাঃ- সিন্ধু নদীর উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল তাই এই নামকরণ।
কালসীমাঃ

হরপ্পা সভ্যতার কালসীমা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দকে উর্ধতন কালসীমা এবং ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে নিম্নতম কালসীমা বলে ধরে নেন অনেকেই।

হরপ্পা/সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার(Harappan/Indus Valley Civilization Discovery):
  • ১৮৭৫ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম হরপ্পা থেকে কতকগুলি সীলমোহর পান। ১৯১২ সালে জে. ফ্লিট আরও কতকগুলি হরপ্পা সিলমোহর আবিষ্কার করেন।। এর সূত্র ধরেই ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম পাঞ্জাবের মন্টগােমারি জেলায় ইরাবতী বা রাভী নদীর তীরে স্যার জন মার্শাল ও দয়ারাম সাহানি হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কার করেন।
  • ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত হয়। মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের গৌরব প্রধানত বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

(১) সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি The Extent of the Harappan Civilisation]: সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার ছিল বেলুচিস্তান থেকে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় সমগ্র পাকিস্তান, আধুনিক ভারতের গুজরাত, রাজস্থান, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব রাজ্য। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এই সভ্যতার পশ্চিমে বালুচিস্তানের সুত্‌কাগেন্‌দর থেকে পূর্বে মিরাট জেলার আলমগির পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । উত্তরে জম্মু ও কাশ্মীরের আখনুর জেলার মান্দা থেকে দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলার দাইমাবাদ পর্যন্ত এলাকা এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল । পুরাে এলাকাটি একটি ত্রিভুজের মতাে এবং এর আয়তন হল প্রায় ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলােমিটার। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার থেকে ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এই সভ্যতা ছিল ২০ গুণ এবং প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মিলিত এলাকার তুলনায় ছিল ১২ গুণ বড়ো। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার দূরত্ব প্রায় ৪৮৩ কিলােমিটার।


সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা (Harappan Civilization Authors): সিন্ধু সভ্যতা কারা গড়েছিল এ সন্বন্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন মত । খনন কার্যের ফলে সিন্ধু উপত্যকায় যে সমস্ত নরকঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে সেগুলি পরীক্ষা করে চারটি জাতিগােষ্ঠীর মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছেঃ প্রােটো অস্ট্রালয়েড, ভূমধ্যসাগরীয়, অ্যালপাইন ও মােঙ্গালীয়। কিন্তু এই নরকঙ্কালগুলি সংখ্যায় এত কম যে পণ্ডিতগণ এগুলির মাধ্যমে কোনাে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পেরে যে সকল মতবাদ পোষণ করেন সেগুলি হলঃ
  • সুমেরীয় সৃষ্ট মতবাদ (Sumerian doctrine)
  • আর্য সৃষ্ট মতবাদ
  • দ্রাবিড় সৃষ্ট মতবাদ (Dravidian doctrine)
  • মিশ্র জাতি মতবাদ

নগর পরিকল্পনা

  • সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা । নগরগুলির মধ্যে হরপ্পা ও মহেন-জো-দরো উল্লেখযোগ্য ।
  • আয়তাকার নগরগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল- i)পশ্চিমভাগে একটি উঁচু এলাকায় ছিল চারদিকে দেয়াল পরিবেষ্টিত ইটের তৈরি দুর্গ(citadel), যেখানে থাকত সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষের আবাসস্থল, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় ভবনগুলি। ii) সাধারণ মানুষের জন্য নীচের শহরাঞ্চল বা উপ-নগরী। এই অংশ দাবার বোর্ডের মতো ওয়ার্ডে বিভক্ত ছিল। সমাধিক্ষেত্রগুলি সাধারণত শহরের বাইরে অবস্থান করত।
  • রাস্তা: শহরের রাস্তাগুলি উত্তর-দক্ষিণে এবং পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল । নগরের রাস্তাগুলি সােজা, প্রস্থে ৯ ফুট থেকে ৩৫ ফুট পর্যন্ত চওড়া এবং দৈর্ঘ্যে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আধ মাইল বিস্তৃত ছিল। ছোট ছোট সরু গলিপথ প্রধান রাস্তার সঙ্গে সমকোণে এসে মিশত । পোড়া ইট, চুন, সুরকি, বালি ও পাথর দিয়ে রাস্তাগুলি তৈরি ছিল। রাস্তার পাশে সমান দূরত্বে ল্যাম্পপোস্টও স্থাপন করা হয়েছিল ৷
  • গৃহনির্মাণ পরিকল্পনা:রাস্তার দু-ধারে ছিল বড়ো বড়ো তিনতলা পর্যন্ত বাড়ি । হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োয় দেখা যায় আগুনে পোড়ানো ইঁটের বাড়ি। লোথাল ও কালিবঙ্গানে দেখা যায় রোদে পোড়ানো ইঁটের(burnt bricks) বাড়ি। সিন্ধুবাসী কাঠের তৈরি দরজা ব্যবহার করত । কিন্তু জানালার কোনো ব্যবস্থা ছিল না । দেওয়ালের উপরে ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল । প্রত্যেক বাড়িতে রান্নাঘর ও উঠনের জন্য স্থান সংরক্ষিত ছিল । প্রত্যেকটি বাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল ৷ বেশির ভাগ বাড়ি দু কক্ষ বিশিষ্ট হলেও বেশি কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িও আবিষ্কৃত হয়েছে ৷শহরের গরিব ও খেটে-খাওয়া মানুষ ছোটো ছোটো অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বাস করত । পাথরের তৈরি বাড়ির নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বাড়িগুলিতে কােনো লোহার নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
  • জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা (Harappan Civilization Drainage System): প্রতিটি বাড়ির শৌচাগারের জল ও বৃষ্টির জল রাস্তার নীচ দিয়ে বড়াে নর্দমায় নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। বাড়ির দূষিত জল নর্দমা দিয়ে এসে রাস্তার ঢাকা দেওয়া বাঁধানো নর্দমায় পড়তো। নর্দমা গুলি পরিষ্কারের জন্য ইট দিয়ে তৈরি ঢাকা ম্যানহোল এর ব্যবস্থা ছিল। জনগণের ব্যবহারের জন্য রাস্তাতেও কূপ খনন করা হত ।
সামাজিক জীবন [Social Life]:
  • নাগরিক জীবনে বৈদিক যুগের মতো বর্ণ প্রথা চালু না থাকলেও ৪টি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ছিল ৷ প্রথম শ্রেণীতে শাসক, পুরোহিত, চিকিৎসক, জ্যোতিষী ৷ দ্বিতীয় শ্রেণীতে যোদ্ধা ৷ তৃতীয় শ্রেণীতে ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর ৷ এবং চতুর্থ শ্রেণীতে ছিল কৃষক, জেলে, তাঁতি, মিস্ত্রি, গৃহকর্মী অর্থাৎ শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ ৷
  • সিন্ধু জনগণের জীবনযাত্রার মান খুব উন্নত ছিল । তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, তরি-তরকারি ও খেজুর । তা ছাড়া তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস ও ডিমও অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
  • সুতিবস্ত্র ছিল তাদের প্রধান পোশাক। পুরুষেরা নিম্ন অংশে ধুতির মত কাপড় এবং উপরিভাগে সুতা দিয়ে তৈরি করা চাদর পরিধান করত ৷ নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল দুই প্রস্থ কাপড় ৷ শীতের দিনে তারা পশমের পোশাক পরত । নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরত । কণ্ঠহার, চুল-বাঁধার অলংকার, বাহুর অলংকার, আঙটি ও চুড়ি নারীপুরুষ উভয়েই পরত। কোমরবন্ধ, নাকছাবি, কানের দুল ও নূপুর কেবল মেয়েরাই পড়ত। সিলমোহরে চুলের কাঁটা ও চিরুনির ছবি পাওয়া গিয়েছে। এমনকি এখানকার লোকেরা এক ধরনের সুর্মা, ফেস-পাউডার, লিপস্টিক, ফেস-পেইন্ট ও সুগন্ধী ব্যবহার করত, যা বাইরে রপ্তানিও করা হত।
  • সিন্ধু জনগণ যেসব জিনিস ব্যবহার করত, তার মধ্যে মাটির তৈরি নানা বাসন, যেমন- থালা, জালা, কলসি, বাটি ইত্যাদি প্রধান । কখনো-কখনো এইসব মাটির পাত্রে নানারকম আলপনা আঁকা থাকত । এ ছাড়া তামা, রুপো, ব্রোঞ্জ ও চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রও পাওয়া গেছে । ছুরি, হাতির দাঁত অথবা হাড়ের তৈরি চিরুনি, কাস্তে, কুড়ুল, চারচৌকো পাথর (ওজনের মাপ) ইত্যাদিও ব্যবহৃত হত ।
  • সিন্ধু জনগণ লেখাপড়া জানত, যার প্রমান লিপি । সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার অবশ্য আজও হয়নি । কালিবঙ্গান থেকে প্রাপ্ত ভাঙা মৃৎপাত্রের টুকরোয় পাওয়া লেখা থেকে প্রমাণিত হয়েছে ডান থেকে বামে এবং বাম থেকে ডানে উভয় দিকেই লেখা চলত। এই লিপির সঙ্গে সুমেরীয়, এলামীয়, হিট্রাইট, মিশরীয়, ক্রটিীয়, ব্রাহ্মী, সংস্কৃত প্রভৃতি বহু লিপির সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
  • মৃতদেহ সৎকার:সিন্ধু জনগণ মৃত দেহ কবর দিত । তবে কখনও মৃতদেহের কঙ্কাল আবার কখনও মৃত দেহ দাহ করে তার ছাই কবর দেওয়া হত । খুব কম ক্ষেত্রেই দেখাবশেষ পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানোর পর সমাধিস্থ করা হত। কবরের মধ্যে মৃতের ব্যবহার্য জিনিসও দেওয়া হত ।
  • আমোদপ্রমোদ: হরপ্পাবাসীদের মধ্যে ইনডোর ও আউটডোর উভয় ধরনের খেলাই প্রচলিত ছিল। তার নাচগানও করত। নলাকার ও শাঙ্কবাকার পাশার ঘুঁটি থেকে প্রমাণিত হয় হরপ্পায় জুয়াখেলাও চলত।
হরপ্পা সভ্যতার জীবিকা (Indus Valley Civilization Occupation):
  • (ক) কৃষিকার্য: সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও কৃষি ছিল সিন্ধু অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা। ধানের কথা জানা না গেলেও গম, যব, কার্পাস, সরিষা, তিল, মটর, খেজুর, ইত্যাদি উৎপন্ন হত। রবিশস্য হিসেবে গম ও যবের চাষ হত। খারিফ শস্য হিসেবে তুলাে, তিল উৎপন্ন হত। হরপ্পার (মেহেরগড় পর্যায়ের) মানুষ বিশ্বের প্রাচীনতম তুলা-উৎপাদকদের অন্যতম। নভেম্বর মাস নাগাদ বন্যার জল নেমে গেলে সিন্ধুবাসীরা সিন্ধু নদের প্লাবন সমভূমিতে শস্য রোপণ করত। এপ্রিল মাসে আবার বন্যা আসার আগেই ফসল কেটে নেওয়া হত। হরপ্পাবাসীরা সম্ভবত কাঠ বা তামার ফলাযুক্ত কাঠের লাঙল ব্যবহার করত।
  • (খ) পশুপালন গোরু, ছাগল, কুকুর , ষাঁড়, মোষ, ভেড়া, শুয়োরছিল প্রধান গৃহ পালিত পশু । তারা হাতিকেও পোষ মানাত; তবে ঘোড়ার ব্যবহার জানত কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে । গাধা ও উট ছিল ভারবাহী পশু । মুরগি পালনের সুত্রপাতও সিন্ধু উপত্যকায়।
  • হরপ্পা সভ্যতার শিল্প (Harappan Civilization Industry):বয়নশিল্প এখানকার প্রধান শিল্প হলেও মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, প্রস্তরশিল্প ও অলঙ্কার শিল্পে অনেক মানুষ নিযুক্ত ছিল।

ব্যবসা-বাণিজ্য

  • অভ্যন্তরীণ ব্যাবসাবাণিজ্য চলত রাজস্থান, সৌরাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের মধ্যে।
  • বিদেশি ব্যাবসাবাণিজ্য চলত মেসােপটেমিয়া বা সুমের, মিশর, ব্যাবিলন, পারস্য এবং বাহারিণের মধ্যে।
  • সিন্ধুবাসীদের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল তুলো, যা রপ্তানি করা হত লোথাল বন্দরের মাধ্যমে। এছাড়াও গম, মটর, তৈলবীজ, বাসনপত্র (Pottery), পুঁথি, টেরাকোটার মূর্তি, ময়ূর, নীলকান্ত পাথর, হাতির দাঁত, চিরুনি, বস্ত্র প্রভৃতি ছিল রপ্তানি দ্রব্য
  • আমদানীকৃত মূল্যবান ধাতুগুলি হল সােনা (আফগানিস্তান, পারস্য এবং দক্ষিণ ভারত থেকে), তামা (রাজস্থান, বালুচিস্তান এবং আরব থেকে), টিন (আফগানিস্থান ও বিহার থেকে), ল্যাপিস লাজুলি (আফগানিস্থান থেকে), টরকোয়েস (পারস্য থেকে) সীসা (পূর্ব অথবা দক্ষিণ ভারত থেকে), ঝিনুক (সৌরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভারত থেকে), জেড পাথর (মধ্য এশিয়া) কার্নেলিয়ান ও এ গেথ (সৌরাষ্ট্র থেকে)।
  • সিলমোহর গুলি সম্ভবত বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হত । তবে সিন্ধু জনগণ মুদ্রার ব্যবহার জানত না । বিনিময় প্রথার মাধ্যমে কেনাবেচা হত।
  • ওজন ও পরিমাপের জন্য কিউবিক প্রথার প্রচলন ছিল। বস্তুর ওজন মাপার জন্য নানা মাপের সুষম বাটখারা ব্যবহৃত হত। তবে তারা দৈর্ঘ্য মাপার জন্য স্কেলের মত লাঠি ব্যবহার করত ৷ তাদের ওজন ছিল ১৬ ভিত্তিক ৷ যেমন- ১৬, ৬৪, ১৬০, ৩২০, ৬৪০ ৷
  • ব্যাবসাবাণিজ্য চলত স্থল ও জলপথে। গােরুরগাড়ি এবং বলদের নিয়ােগ করা হত স্থলপথের জন্য এবং জাহাজ ও নৌকার দ্বারা জলপথে ব্যাবসা হত
ধর্মীয় জীবন [Religious Life] :
  • সিন্ধুজনগণের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল । সিন্ধু উপত্যকার এই মূর্তিগুলিতে ধোঁয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। মনে হয় দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য ধূপ - তেল দেওয়া হত এবং সামনে প্রদীপ জ্বালা হত। তাদের উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়া হত। একটি সিলে নরবলির চিহ্ন স্পষ্ট।
  • একটি সিলে বাঘ, হাতি, গণ্ডার, মহিষ ও হরিণ — এই পাঁচটি পশু দ্বারা পরিবৃত ও ত্রিমুখবিশিষ্ট ধ্যানমগ্ন এক যােগামূর্তি দেখা যায়। মূর্তিটির মাথায় দুটি শিং আছে। অনুমান করা হয়েছে যে, সম্ভবত ইনি হলেন পশুপতি মহাদেব, কারণ হিন্দু ধারণায় শিৰ হলেন ত্রিমুখ, পশুপতি ও যােগেশ্বর।
  • মূর্তিপূজা ছাড়া শক্তির আরাধ্যরূপে পাথর, গাছ ও জীবজন্তুর পূজাও প্রচলিত ছিল ।
  • মন্দিরের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি ।

(৪) সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ [Causes of Decline of the Harappan Civilisation] : বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে সিন্ধু সভ্যতার পতনের সম্ভাব্য কারণগুলি হল-

(১) কারও মতে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব এই সভ্যতার পতন ডেকে এনে ছিল ।

(২) অনেকের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা, অনাবৃষ্টি এই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ। বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন বলে অনেকে মনে করেন ।

(৪) কেউ কেউ মনে করেন নদীর গতিপথের পরিবর্তনের ফলে মরুভূমি সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি এই সভ্যতার পতনের কারণ।

(৫) কেউ কেউ মনে করেন ভূমিকম্প এই সভ্যতার পতন ডেকে এনে ছিল ।

(৬) অনেকের মতে, বিদেশি শত্রু অর্থাৎ আর্যদের আগমন এই সভ্যতার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান :


হরপ্পা:

  • দয়ারাম সাহানী ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মন্টোগােমারী জেলায় ইরাবতী (রাভি) নদীর তীরে হরপ্পা আবিষ্কার করেন।
  • সিন্ধু সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত স্থানটি হল হরপ্পা।
  • দুই সারিতে ছয়টি করে মোট বারটি (১২) শস্যাগারের(granaries) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
  • নৃত্যরত নটরাজ মূর্তি পাওয়া গেছে।
  • একমাত্র হরপ্পাতেই কফিন সমাধির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।
  • মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে ব্যবসার উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • বছরে দুইবার চাষের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
  • ইটের চুল্লি পাওয়া গেছে।

মহেঞ্জোদাররো :

  • রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান পাকিস্তানের লাহােরের লারকানা জেলায় সিন্ধু নদীর তীরে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করেন।
  • মহেঞ্জোদারো কথার অর্থ হল 'মৃতের স্তুপ' (mound of the dead)।
  • এখানে বৃহত্তম স্নানাগার (Great bath) পাওয়া গেছে যার দৈর্ঘ্য ৩৯ ফুট, প্রস্থ ২৩ ফুট এবং গভীরতা ৮ ফুট। স্নানাগারের মেঝে ছিল সুন্দর পােড়া ইটের। ইটগুলাে তৈরি হয় জিপসাম এবং মর্টার দিয়ে। স্নানাগারটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হত এবং এর সন্নিহিত ঘরগুলি ছিল পুরোহিতদের বাসস্থান। জলাশয়টিতে জল ভর্তির জন্য একটি ঘরে ইট দিয়ে বাঁধানো কূপ ছিল । ঋতুভেদে জল গরম বা ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থাও ছিল। এই জলাধারের তিনদিকে ছিল বারান্দা এবং একদিকে ছিল ছোট ছোট কিছু ঘর।এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১.৮৯ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ৭.০১ মি. এবং গভীরতা ২.৪৪ মি. ।
  • মহেঞ্জোদারাের বৃহত্তম বাড়িটি হল শস্যাগার (Great Granary)। এটি দৈর্ঘ্যে ১৫০ ফুট, প্রস্থে ৫০ ফুট।
  • এখানে বহু স্তম্ভ বিশিষ্ট সভাগৃহ এবং বড়াে আয়তক্ষেত্রাকার বাড়ি পাওয়া গেছে। মনে করা হয় এগুলি ব্যবহৃত হত প্রশাসনিক কাজে।
  • আগুনের বেদী (Fire Altars), পশুপতি শীলমােহর, মাতৃমূর্তি, জোড়া সমাধি, টেরাকোটার গােরুর গাড়ি এবং চাকাসমেত গােরুর গাড়ি, সােনার অলঙ্কার, স্টিটাইট (Steatite) ও টেরাকোটায় নির্মিত জাহাজ মহেঞ্জোদারােতে পাওয়া গেছে। সুতোকাটার টাকু, চরকা ও সূচের সঙ্গে একটুকরো বোনা কাপড়ও পাওয়া গিয়েছে এখান থেকে। দাড়িওয়ালা পুরুষের পাথরের মূর্তি এবং নর্তকীর ব্রোঞ্জ মূর্তি এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে।

লােথাল :

  • ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে এস.আর.রাও (S. R. Rao) বর্তমান গুজরাটের আমেদাবাদ অঞ্চলের সারাঙ্গা জেলায় খাম্বাত উপসাগরের উপকূলীয় সমভূমিতে ভাগবা নদীর তীরে লােথাল আবিষ্কার করেন।
  • লােথাল বিশ্বের প্রাচীনতম পােতাশ্রয়।
  • লােথাল মূলতঃ শেলের (Shell) অলঙ্কার এবং পুঁথির অলঙ্কারের জন্য প্রসিদ্ধ।
  • এখানে আগুনের বেদী, টেরাকোটার ঘােড়া, পার্শিয়ান শীলমােহর, তুষ, মাছ ও পাখি চিত্রিত বাসনপত্র (Pottery), হরপ্পার শীলমােহর, জোড়া কবর এবং কাপড়ের টুকরাে পাওয়া গেছে।
  • ধান চাষের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
  • লোথালে বাড়ির দরজা বড়ো রাস্তারই দিকে।

কালিবঙ্গান :

  • এ. ঘােষ (A. Ghosh) ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান রাজস্থানের গঙ্গানগরের হনুমানগড়ে কালিবঙ্গান আবিষ্কার করেন ।
  • কৃষিকার্যের জন্য ব্যবহৃত কাঠের লাঙলের ব্যবহার জানা যায়।
  • সেচ ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া যায়।
  • এখানে আয়তাকার কবর, আইভরি নির্মিত চিরুনী, তামার বালা, কাঠের খেলাগাড়ি, লিঙ্গ ও যােনি এবং তামার ষাঁড় পাওয়া গেছে।
  • ভূমিকম্পের প্রমান পাওয়া গেছে।
  • উটের হাড় পাওয়া গেছে।
  • বৃত্তাকার ও আয়তকার কবর পাওয়া যায়।
  • পোড়া ইটের ব্যবহার ও drainage system ছিল না।

চানহুদারাে :

  • ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে এম জি মজুমদার (M. G. Mazumdar)বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সরকন্দ অঞ্চলে চানহুদারাে আবিষ্কার করেন।
  • এটি একমাত্র স্থান যেখানে কোনাে দুর্গ ছিল না।
  • এখানে কালির দোয়াত, পুঁথি তৈরির দোকান, শেলের জিনিষ এবং বালার জিনিষ পাওয়া গেছে। একটি কুকুর বিড়াল তাড়া করেছে, এমন কয়েকটি পদচিহ্নও পাওয়া গিয়েছে।
  • এখানে টিন, তামা, সােনা, রূপার ব্যবহার হত।
  • এই স্থান চানহুদারাের জলনিকাশী ব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে সুন্দর।

ধােলাভীরা :

  • ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে জে.পি.জোশী (J.P. Joshi) বর্তমান গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলে ধোলাভীরা আবিষ্কার করেন।
  • এটি বিখ্যাত সুন্দর জল সরবরাহ ও নিকাশী ব্যবস্থার জন্য।
  • এখানে সাইনবাের্ড পাওয়া গেছে।
  • এটি গােলাপী সাদা রং-এর দেওয়াল, রাস্তা, মেঝে ইত্যাদি দ্বারা চিত্রিত ছিল।

রংপুর :

  • ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এম.এস ভাটস (M.S. Vats)বর্তমান গুজরাটের সৌরাষ্ট্রের কাছে মাহার নদের তীরে রংপুর আবিষ্কার করেন।
  • এখানে ধানের তুষ, ছয় প্রকারের বাসনপত্র পাওয়া গেছে।
  • রংপুরই একমাত্র হরপ্পা প্রত্নক্ষেত্র যেখানে ধানের ভুসি পাওয়া গিয়েছে।

সুরকোটডা :

  • ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জগপত যােশী বর্তমান গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলে সুরকোটডা আবিষ্কার করেন।
  • এটি সমাধিগৃহ, ঘােড়ার দেহাংশ ইত্যাদি এখানে পাওয়া গেছে।

রােপার :

  • ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়াই.ডি.শর্মা (Y. D. Sharma)পাঞ্জাবের শতদ্রু নদীর তীরে আবিষ্কার করেন।
  • এটি এখানে হরপ্পার মতাে বাসনপত্র, ডিম্বাকার পিট, মানুষের পাশে কুকুরের সমাধি, এবং তামার কুঠার পাওয়া গেছে।

বনওয়ালী :

  • ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আর.এস. বিস্ত (R. S. Bisht) হরিয়ানার হিসার জেলাতে সরস্বতী নদীর তীরে আবিষ্কার করেন।
  • এখানে কোনাে নর্দমা ছিল না। এখানে ভালাে জাতের বার্লি পাওয়া গেছে। বারােটি শিংযুক্ত বাঘের শীলমােহর পাওয়া গেছে। মাটির লাঙলের মডেলও এখানে পাওয়া গেছে। এখানে আদি হরপ্পা ও হরপ্পা উভয় পর্যায়ের জনবসতির সন্ধান মিলেছে। বনওয়ালি প্রচুর যব চাষ হতো।

আলমগীরপুর :

  • এটি উত্তরপ্রদেশের মীরাট জেলার হিন্দন নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় এটি আবিষ্কার করে। এখানে জার বা পাত্র, চোঙাকৃতি (cylindrical) বাসনপত্র পাওয়া গেছে। এই স্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্য পেন্টেড গ্রেওয়্যার।

সুক্তাজেন্দোর :

  • পাকিস্তান-ইরান সীমান্তের কাছে বালুচিস্তান প্রদেশের দাস্ত নদের তীরে অবস্থিত। ১৯২৭ সালে স্যার অরেলস্টাইন (আর. এল. স্টেইন) এটি আবিষ্কার ও খনন করেন।
  • এখানে তামার কুঠার, ও পাখির ছবি আঁকা বাসন পাওয়া গেছে। এটি ছিল একটি উপকূলীয় বাণিজ্য কেন্দ্র।

কোটদিজি :

  • এটি অবস্থিত সিন্ধের ক্ষিরপুর অঞ্চলে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফজল আহমেদ, ঘুরি এটি আবিষ্কার করেন।
  • এখানে পাথরের তীরের মাথা, যাঁড়ের প্রতিকৃতি, পিপুল পাতা, স্টিটাইট শীলমােহর, তামাব্রোঞ্জের বালা, কাচা ইটের মেঝে ইত্যাদি পাওয়া গেছে।

রাখিগ্রহী :

  • অমরেন্দ্রনাথ এটি আবিষ্কার করেন। রাখিগ্রহী এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো প্রত্নক্ষেত্র।
  • এখানে মহিলাদের সমাধি, পশুপালন (Animal Husbandry) এবং হস্তশিল্প পাওয়া গেছে।

আলমুরাদ :

  • এটি সিন্ধুর দাদু অঞ্চলে অবস্থিত।
  • এটি ছিল দুর্গ পরিবেষ্টিত এবং মাঝে ছিল একটি বড়াে কুঁয়াে। এখানে লাল ও কালাে রঙের বাসন পাওয়া গেছে।

বালাকোট :

  • এটি করাচীর লাসবেলা অঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে জর্জ এফ. দালেস (G.E. Dales) এটি আবিষ্কার করেন।
  • পাথরের জার, শেলের জিনিষ এবং পুঁথির জিনিষের জন্য এটি বিখ্যাত।

দেশালপুর :

  • এটি গুজরাটের ভূজ অঞ্চলে ভাদর নদীর তীরে অবস্থিত। পি.পি.পান্ডে এবং এম. কে. ধাকি এটি আবিষ্কার করেন।
  • এখানে একটি দুর্গ পাওয়া গেছে। আলহাদিনাে ও করাচীর উপকূল অঞ্চলে এটি অবস্থিত। ডব্লিউ. এ. ফেয়ারসার্ভিস এটি আবিষ্কার করেন।

আমরি:

  • সিন্ধুপ্রদেশেই সিন্ধু নদের তীরে ননীগোপাল মজুমদার ১৯৩৫ সালে আবিষ্কার করে আমরির ধ্বংসাবশেষ।
  • এখানে একটি কৃষ্ণসার হরিণের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে।